‘‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—আমার পরে পুরুষের জন্য নারীর চাইতে অধিক ক্ষতিকর আর কোন ফিতনা রেখে যাইনি। ( বুখারি- ৫০৯৬,মুসলিম – ২৭৪০)’’
আপনি একটা শিশুর দিকে তাকিয়ে আনন্দ আর বিস্ময় মিশিয়ে বললে—`বাহ, তুমি এতো সুন্দর! আমি তো ফিতনায় পড়ে গেলাম’। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি,শিশুটা এতো আনন্দ পাবে! আপনার এই অসাধারণ প্রশংসা বাক্যটি সে জীবনে কোনদিন ভুলবে না। একই বাক্য দিয়ে যদি একজন নারীকে প্রশংসা করা হয়,এর মর্ম কি পাল্টে যাবে? এই বিস্ময়মাখা আনন্দের কথাটিকে সে কি অপমান হিসেবে নিবে? নারীদের স্বভাব গতি বুঝে এমন যে কেউই বলবে—অসম্ভব!
নারীর কোমল প্রকৃতিটিই এমন। মিষ্টি কথা তার মন ভুলিয়ে দেয়। একটু প্রশংসার বাণী তার হৃদয় ও আত্মাকে সজীব ও প্রফূল্ল করে তোলে। তার প্রশংসা করতে গিয়ে কেউ তাকে “ফিতনা” বললেও সে খুশি হয়। কারণ, সে খুব ভালোভাবেই জানে এ ফিতনার মানে কী। তার দিকে তাকিয়ে যে ব্যক্তি কথাটি বলেছে, সে তার অপূর্ব রূপের বিদ্যুতে স্পৃষ্ট হয়ে আছে, নিজেকে ভুলে গেছে এবং কোনভাবেই আর চোখ ফেরাতে পারছে না। ফিতনা বলতে এখানে তার কাছে এটিই। এতে অপমান নেই; আছে প্রশংসা,সোন্দর্য়মুগ্ধতা,বিস্ময়ের আনন্দ। এবং সত্যও তাই। নারীর সোন্দর্য়ের এই ফিতনার দিকটি লক্ষ্য করেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—আমার পরে পুরুষের জন্য নারীর চাইতে অধিক ক্ষতিকর আর কোন ফিতনা রেখে যাইনি। ( বুখারি- ৫০৯৬,মুসলিম – ২৭৪০)
এই হাদিসটি ঘুরে ফিরে বার বার আমাদের আলোচনায় আসে। বিশেষত হিজাবের গুরুত্ব ও হিজাব আবশ্যক হওয়া নিয়ে যখন আলোচনা উঠে, তখন আমরা সকলেই হাদীসটিকে সামনে আনি। এ সময়ে অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে আমরা দেখি অনেকে নবীজির এই বক্তব্য নিয়ে অস্বস্তিতে পড়ে যান। যেন কথাটিকে কোনভাবে লুকিয়ে ফেলতে পারলেই সুবিধা হতো। এবং সংখ্যায় তারা অল্প নন।
কিন্তু আপত্তিটা ঠিক কিসের উপর? আমার জানা নাই। হয়তো তারা হাদিসটিকে নিজেদের জন্য অপমানজনক মনে করেন। আমাদের অনেক দুঃখ ও মনোকষ্টের উৎপত্তিই হয় নিজেদের ভুল বুঝাবুঝি থেকে । এটা তো গোপন কোন কথা নয় যে, পুরুষের উপর নারী যতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারে,পৃথিবীর আর কোন জিনিস তার সমকক্ষ নয়। নারী খুব সহজেই তার সবচে মর্মভেদি অস্ত্র—প্রেম ও ভালোবাসা দিয়ে পুরুষকে বেঁধে ফেলতে পারে, পরিচালনা করতে পারে নিজের ইচ্ছে মতো। এজন্যই দেখা যায় নারী যদি উত্তম গুণাবলী ও সচ্চরিত্রের অধিকারিনী হয়, তাহলে তার স্বামীকেও সে ভালো করে ফেলতে পারে,অন্তত ভালোর পথে এগিয়ে নেয়। কিন্তু নিজে যদি খারাপ হয়, তাহলে স্বামীকেও বিভ্রান্ত করে। এটা তো সত্য এবং এমন নয় যে সূক্ষ্ম যুক্তিতর্কের ভিতর দিয়ে একে বুঝতে হবে; এ বরং নিত্য চোখে দেখা একটি বাস্তবতা। স্পষ্টতই আলোচ্য হাদীসটিতে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীর এই শক্তি ও প্রভাব বিস্তারের গুণটির কথা বলেছেন, তার এই শক্তির সামনে পুরুষের দূর্বলতাটির কথা বলছেন। এটা কিভাবে তার জন্য অপমানকর হয়?
আমরা একটি মজলিশে বসে ছিলাম। আমার এক বান্ধবী, আল্লাহ যাকে ইলম ও আমলের পাশাপাশি কোমলতা এবং হৃদয়ের প্রশস্ততাও দান করেছেন,সে যখন তার এই বিশদ বিশ্লেষণের পর সবার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল—আমাকে বলুন, সত্য ও বাস্তবতাকে প্রকাশকারী চমৎকার এই হাদিসকে কোন যুক্তিতে নারীর জন্য অপমানকর ভাবা হয়? তখন মজলিসের মাঝখান থেকে একজন নারী ফুঁসে উঠলেন – ধরলাম আপনার কথাই সত্য—“ফিতনা” হওয়াটা অপমানজনক নয়; এ বরং নারীর শক্তিশালী হওয়ার দিকেই ইঙ্গিত করে; কিন্তু পুরুষের জন্য সবচে ক্ষতিকর ফিতনা হিসেবে দেখানো হলো কেন? তার দিকে এই নেতিবাচক দৃষ্টিতে তাকানোর বিশেষত্বটা কী? কেন নারীকেই সবসময় বিপদ হিসেবে দেখা হয়?
সে কথা বলছিল একশ্বাসে,মুখ হয়েছিল লাল বর্ণের। দেখেই বুঝা যাচ্ছে এই আপত্তি মনে নিয়ে কতটা রাগান্ন্বিত ও ক্ষুব্ধ হয়ে ছিলো সে।
আমার বান্ধবী তার দিকে তাকিয়ে নরম করে মুচকি হাসলো,তারপর নেহায়েত শান্ত গলায় পাল্টা প্রশ্ন করলো—প্রিয় বোন,শান্ত হও! তার আগে বলো ফিতনা শব্দের অর্থটা কী? সব কথার আগে এটা জেনে নেওয়া জরুরী। এতে আমরা পরস্পরকে খুব সহজে বুঝতে পারব।
সেই নারীটি দুই দিকে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো,আমি ঠিক জানি না আসলে। হয়তো যে-কোন সুন্দর ও লোভনীয় জিনিসকেই ‘ফিতনা বলা’ হয় । এই বলে সে আচমকা হেসে ফেললো ।
-আচ্ছা, এই যদি ফিতনার অর্থ হয়,তাহলে ক্ষুব্ধ হওয়ার কী আছে?
-এটা আমাকে জিজ্ঞেস করবেন না দয়া করে;আমি জানিনা; কিন্তু যখনই হাদিসটি শুনি, আমার রক্তচাপ বেড়ে যায়।
-আহা, আল্লাহ তোমাকে সব ধরণের অকল্যাণ থেকে নিরাপদ রাখুন। বিষয়টা তোমার রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়ার মতো কঠিন কিছু নয় নিশ্চয়ই। এই হাদিসের প্রকৃত অর্থ ও মর্মটি বুঝতে পারলে আমি নিশ্চিত তুমি তোমার মত পাল্টাবে।
দেখো, ‘ফিতনা’ বিশেষণটি মোটেও নারীদের খাটো করার জন্য কিংবা ত্রুটি হিসেবে বলা হয়নি। তুমি নিজেই বলেছো, ফিতনা মানে হলো যে কোন সুন্দর ও লোভনীয় জিনিস। এই অর্থটাই সঠিক।
আল্লাহ মানুষকে যত নিয়ামত দান করেছেন,এবং মানুষ যা কিছু মনে প্রাণে ভালোবাসে,এমন প্রতিটি জিনিসই তার জন্য ফিতনার কারণ হয়ে দাঁড়ায় । অর্থাৎ এর মাধ্যমে তাকে একধরণের পরীক্ষার সম্মুখীন করা হয়। আর পৃথিবীতে পুরুষের জীবনে সবচে সুন্দর ও প্রিয়তম বিষয় হলাম আমরা—এই নারীকুল। আমাদের জন্য পুরুষগণ যেমন নেয়ামত, তেমনি পুরুষের জীবনে নারীরা তেমনই—আল্লাহ প্রদত্ত অনেক বড় একটি নেয়ামত। তবে এর দুটি দিক রয়েছে:নারী একদিকে যেমন তার জীবনে সৌভাগ্য, সুখ ও আনন্দ বয়ে আনে, অপরদিকে জীবনের বাঁকে বাঁকে নারীর মাধ্যমেই তাকে ভীষণ পরীক্ষার মুখে ফেলা হয়। কাউকে এ পরীক্ষার মুখোমুখি হয় প্রতিনিয়ত, প্রতিটি প্রহরে। অনেকেই এ পরীক্ষায় অকৃতকার্য় মোলিকভাবে কয়েকটি কারণে:
১. কখনও খোদ নারীকে দিয়েই তাকে পরীক্ষায় ফেলা হয়। তখন সে ওই নারীকে শরীয়তনিষিদ্ধ উপায়ে কামনা করে বসে। এ সময়টিতে সে ব্যকুল ও হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়, ফলে চরিত্র ও ব্যাক্তিত্বের পরীপন্থি নানা অশ্লীল কাজে জড়িয়ে পড়ে। বোধ করি এটাই সবচে ভয়াবহ ও বিপদজনক পরীক্ষা।
২. অথবা তাকে পরীক্ষা করা হয় নারীর ভালোবাসায় বন্দি করে। তাঁর প্রেমে সে এমনভাবে অন্ধ হয়,কিছুই দেখে না। প্রেমময়ী নারীর আগ্রহ ও ইচ্ছার কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করা বন্দি এক মানুষ। সে যা বলে তাই মেনে নেয়। নির্দেশটি ভালো কি মন্দ সে দিকে ফিরে তাকানোর অবসর নেই। নারীর সন্তুষ্টি অর্জনই তার একমাত্র লক্ষ্য ও অভিষ্ট গন্তব্য। এটা তার দীনদারিতার জন্য ক্ষতিকর,সে নারীটি তার স্ত্রী হলেও। কখনও তার পাল্লায় পড়ে মা বাবাকে কষ্ট দেয়,কখনো নষ্ট করে তাদের হক। পৃথিবীতে কত স্বামী স্ত্রীর চাহিদা পূরণের জন্য হালাল হারামের তোয়াক্কা করে না,সম্পদ উপার্জনের জন্য অন্ধের মতো ছুটে। শরীয়ত তার কাছে তখন নিতান্ত গোন হয়ে দেখা দেয়। সে জায়গায় স্ত্রীর সন্তুষ্টি ও চাহিদাই তার কাছে মুখ্য ও একমাত্র বিষয়।
৩.নারী দিয়ে তাকে পরীক্ষায় ফেলা হয়ে বিপরীতভাবেও। শরীয়তের নির্দেশ হলো স্ত্রীর সাথে সদাচরণ করা, উত্তমভাবে জীবনযাপন করা, তাকে ভালোবাসা এবং প্রয়োজনীয় সমস্ত হক আদায় করা। কিন্তু সে উল্টো আচরণ করে শরীয়ত লংঘনের পাপ করে। ফলে, সে পতিত হয় মহা বিপদের মাঝে, মুখোমুখি হয় কঠিন শাস্তির। মনে রাখি, ফিতনার এক অর্থ কিন্তু বিপদ ও শাস্তি। যেমন আল্লাহ কুরআনে বলেন – فتنتم انفسكم অর্থাৎ তোমরা নিজেদেরকে বিপদ ও শাস্তির দিকে ঠেলে দিয়েছো।
তো, আলোচ্য হাদিসটি মৌলিকভাবে এই সতর্কবাণীকেও বহন করে—নারীর উপর পুরুষের নির্যাতন,তাঁর সাথে সার্বিক মুআমেলা। পুরুষের জন্য এটাও সবচেয়ে বড় ফিতনা বা পরীক্ষাগুলোর একটি। যদি সে উত্তম আচরণ করতে না পারে, কিংবা তার অধিকার আদায়ে অবহেলা করে,তাহলে সে নিজের জন্যই ক্ষতি ডেকে আনলো। এর ফলাফল যদি দুনিয়াতে নাও ভোগ করে,আখেরাতে কোনমতেই পার পাবে না।
যে পুরুষ নারীর ব্যপারে সীমালংঘণ করে সে মূলত নিজের উপরই জুলুম করে। আমি সমস্ত কুরআন ঘেঁটে দেখেছি, ‘‘নিজের উপর জুলুম” করার বিষয়টি আল্লাহ দুইটি আয়াতে বলেছেন, এবং উভয় আয়াতে ওই সমস্ত পুরুষদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন, যারা নারীর উপর জুলুম করে কিংবা তাদের ব্যাপারে সীমালংঘন করে। আয়াত দুটো লক্ষ্য করুন:
১. আল্লাহ বলেন—তোমরা তাদেরকে আটকে রেখো না তাদের ক্ষতির উদ্দেশ্যে। এমনটা যে করবে সে নিজের উপরই জুলুম করবে। (সূরা বাক্বারা, আয়াত: ২৩১ )
২. তিনি আরো বলেন—তোমরা তাদেরকে বসবাসের ঘর থেকে বের করে দিও না,এবং তারাও যেনো বেরিয়ে না যায়, যদি না তারা কোন স্পষ্ট অশ্লীলতায় লিপ্ত হয়ে পড়ে। এগুলো আল্লাহর সীমা। আর যে কেউ আল্লাহর সীমা অতিক্রম করলো সে তো নিজের উপরই জুলুম করলো ।
বলুন, নিজেই নিজের ধ্বংস কে ডেকে আনার চাইতে বড় ক্ষতি আর কি আছে?
আমার মনেই নাই আমার বান্ধবী কোন কথা থেকে এই হাদিসের আলোচনা শুরু করলো ,এবং শেষ পর্যন্ত চমৎকার জ্ঞাণগর্ভ একটি দরস সম্পন্ন করে ফেললো। আমার খুবই আনন্দ হলো এটা দেখে যে,সে শ্রোতাদেরকে মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনতে বাধ্য করেছে। এমনিতে এরা কখনও কারও কথা মনযোগ দিয়ে শুনতে অভ্যস্ত নয়; কিন্তু বান্ধবীটির ছিল আল্লাহ প্রদত্ত চমৎকার ইলম এবং কথা বলার অপূর্ব যোগ্যতা। তার সে কথাগুলো থেকে যেন মমতা ও স্নিগ্ধতা কুয়াশার মতো ঝরছিল। বান্ধবী তার দরস শেষ করলো এই বলে—যাক, মূল কথা আশা করি সকলের কাছেই পরিষ্কার হয়েছে। এবং হাদিসে নারিদেরকে ফিতনা বলার উদ্দেশ্য যে তাদেরকে খাটো বা অসম্মান করা নয়,এ ব্যাপারে আর কারো কোন সন্দেহ নাই।
এবং আসলেই তার আলোচনা সকলের সামনে বিষয়টিকে অত্যন্ত পরিস্কার করে দিয়েছে। আমি মুগ্ধ বিস্ময়ে শুনছিলাম। সীমাহীন ভালো লাগায় বুকটা ভরে উঠছিল। মন খারাপ করে ভাবছিলাম দারুণ এই আলোচনাটি বুঝি এখানেই শেষ হলো; কিন্তু তখনই আরেকজন উঠে দাঁড়ালো, এরপর গুরুগম্ভির কন্ঠে বলতে শুরু করলো—আমার মনে একটি প্রশ্নের উদয় হয়েছে—কেন নারীই কেবল ফিতনা হবে? পুরুষ কি ফিতনার কারণ হতে পারে না?
তার এই কথায় উপস্থিত মহিলারা মুখে হাসি চেপে একজন আরেকজনের দিকে চোরা দৃষ্টিতে তাকাতে লাগলো। তাদের ভঙ্গিতে বুঝা যাচ্ছে—একদম ঠিক জায়গাতেই হাত দিয়েছো। এই একই প্রশ্ন আমাদের মনেও খোঁচাখুঁচি করছে ।
-কে বলছে পুরুষ ফিতনার কারণ হয় না? অবশ্যই হয়। নারী-পুরুষ উভয়েই পরস্পরের জন্য ফিতনা।বরং তাদেরকে এরচাইতেও বড় কিছু হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে—একে অপরের শত্রু। লক্ষ্য করে দেখুন, আল্লাহ বলছেন:হে মুমিনগণ,তোমাদের কোন কোন স্বামী-স্ত্রী-সন্তান তোমাদের শত্রু,অতএব তাদের ব্যাপারে সতর্ক হও। ( সুরা তাগাবুন- ১৪)
হাদিসে বর্ণিত ফিতনাকে নারির মাঝে সীমাবদ্ধ রাখার মানে এই না যে, পুরুষ কোন ফিতনা হতে পারে না;বরং পুরুষও নারীর জন্য ফিতনা। এজন্যই আল্লাহ নারীদেরকে আদেশ করেছেন তারা যেন চলাফেরার সময় তাদের দৃষ্টিকে অবনত রাখে। ( সুরা নূর- ৩১)
কিন্তু একটা বাস্তবতা কি—বুদ্ধিমান মানুষ মাত্রই দেখে,শুনে এবং অনুভব করে যে, পুরুষরাই সবচে বেশী নারীকেন্দ্রিক ফিতনায় পতিত হয়,এবং তাদেরই নারীর প্রয়োজন সবচে বেশি । একজন পুরুষ আরেকজন নারীকে যতটা তীব্র ও প্রবলভাবে কামনা করে, এবং যে সংখ্যক পুরুষ এই ফিতনা পতিত হয়েছে এবং হয়ে আছে, এর সামান্যও নারীদের মাঝে দেখা যায় না। খুব কম নারীই কোন পুরুষের প্রতি তার আকর্ষণের বিষয়টি প্রকাশ করেন। বরং এটাই স্বভাবজাত রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে যে,পুরুষই নারীকে খুঁজে নেবে,এবং এর জন্য সে তার জান মাল ব্যায় করবে । কিন্তু এর বিপরীতটা খুব বেশি শুনা যায় না। পৃথিবীর দিকে বিস্তৃত নজর দিন, দেখুন, এরপর বলুন এ বাস্তবতা আপনি অস্বীকার করতে পারবেন? এজন্যই আল্লাহ কুরআনে জান্নাতের যেসব নিয়ামতের বিবরণ দিয়েছেন,এর মাঝে বিশেষভাবে পুরুষদের জন্য জান্নাতি হুরদের কথা উল্লেখ করেছেন । যেহেতু এর প্রতিই তাদের আগ্রহ ভালোবাসা বেশি। কিন্তু নারীদের ব্যাপারে এমন কিছু বলেন নি।
দ্বিতীয়ত এই হাদিসে খুবই সূক্ষ্ম কিন্তু চমৎকার একটি লক্ষ্যণীয় বিষয় রয়েছে । হাদিসটি নিয়ে একটু চিন্তা ভাবনা করলে সহজেই সেটা টের পাওয়া যাবে—এই যে হাদিসে নারীদেরকে ফিতনা বলা হয়েছে, এটা কিন্তু তাদের সত্বাগত বিশেষণ হিসেবে বলা হয়নি। এটা এমন কোন বিশেষণ নয়, যা তাদের অস্তিত্বের সাথে আবশ্যিকভাবে যুক্ত। হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্পষ্ট করেই বলেছেন—‘আমি আমার পরে রেখে যাইনি…’ এই ফিতনার বিষয়টি প্রকাশিত হবে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দুনিয়া থেকে বিদায়ের পর । রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবদ্দশায় যেসব নারীরা ছিলেন, তাদের কে এই কথা বলা হয়নি । যদিও তাদের মাঝে এমন কেউ কেউ ছিলেন—সাময়িকভাবে শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে ফিতনায় পড়ে গেছেন এবং যিনার মতো নিন্দনীয় কাজে জড়িয়ে পড়েছেন। কিন্তু এগুলো একেবারেই বিরল ও বিচ্ছিন্ন ঘটনা ,যা দিয়ে ওই সময়ের গোটা সমাজকে বিচার করা যায় না ।
এ থেকে স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, ফিতনা হওয়াটা প্রত্যেক নারির জন্য আবশ্যিক ও অস্তিত্বগত বিষয় নয়, বরং কোন কোন নারীর মাঝে কোন এক বিশেষ সময়ে দেখা দেবে এটা। নারি পুরুষ উভয়ের মাঝেই ঈমান ও তাকওয়ার দূর্বলতা দেখা দেবে, কোন কোন নারী পর্দার ব্যপারে শিথিলতা করবে, নিজের সৌন্দর্য় প্রদর্শন করে বেড়াবে, ফলে দুর্বল ঈমানের পুরুষরা তাদের মাধ্যমে ফিতনায় পতিত হবে।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেভাবে কিছু মন্দ স্বভাব ও গুণাবলীর কথা বলে গেছেন, যেগুলো কতিপয় নারীদের মাঝে প্রকাশ পাবে, ঠিক একইভাবে এমন বহু মন্দ ও খারাপ গুণাবলীর কথা বলে গেছেন, যা পুরুষদের মাঝে প্রকাশিত হবে। এক হাদিসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন—তোমাদের পর এমন এক দল আসবে,যারা আমানত রক্ষা করবে না,খিয়ানত করবে। তাদের কাছে স্বাক্ষ্য চাওয়া না হলেও যেচে পড়ে স্বাক্ষ্য দিবে। মান্নত করে তা পূরন করবে না এবং তাদের শরীরে দেখা দিবে স্থুলতা। ( বুখারী- ২৬৫১)
এমন আরও অসংখ্য হাদিস রয়েছে, যেগুলোতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পুরুষদের বিভিন্ন মন্দ ও নিন্দনীয় স্বভাব চরিত্র নিয়ে কথা বলেছেন। কিন্তু কই, কোন পুরুষতো এসবকে নিজের জন্য অপমানজনক বলে মনে করেনি !
মজলিসটি পূর্ণ ছিলো বিভিন্ন ধরণের ও বিভিন্ন বয়সের নারীদের দ্বারা। তাদের মধ্য থেকে এক বৃদ্ধা উঠে দাঁড়ালেন, বয়স আনুমানিক ষাট হবে। মনে হলো অনেক গভীর চিন্তাভাবনার পর একটি প্রশ্ন করছেন। আমার মনে হচ্ছে এর উত্তরও তার জানা আছে, কিন্তু মজলিসের সকলেই যেন উত্তরটি পেতে পারে, সেজন্য আবার প্রশ্নটি উত্থাপণ করলেন।
-আচ্ছা, তাহলে কি হাদিসের অর্থ এই দাড়াচ্ছে না যে, নারিদেরকে ভালোবাসা কিংবা তাদের সাথে সম্পর্ক রাখার ব্যপারটাই মন্দ কিছু?
-মাফ করবেন খালা, আপনার এমনটি মনে হচ্ছে কেন? কিংবা হাদিস থেকে এই অর্থ কি করে বের করলেন?
-কারণ হাদিসে তো নারীকে ফিতনা বলা হচ্ছে! আর ফিতনা থেকে দূরে থাকাই কি উচিৎ না?
-আচ্ছা, আপনার কথা ঠিক। কিন্তু ফিতনা ভালো এবং মন্দ উভয় ক্ষেত্রেই হতে পারে। আল্লাহ বলছেন—ولنبلونكم بالشر والخير فتنة অর্থাৎ, আমি তোমাদেরকে ভালো ও মন্দ ফিতনা দিয়ে পরীক্ষা করবো। আপনার প্রশ্নটি খুবই ভালো লেগেছে আমার। এর জবাব হলো—নারীকে ভালোবাসা কিংবা তার প্রতি টান রাখা মোটেও মন্দ কিছু না। যে কুরআন পাঠ করবে, সে দেখতে পাবে আল্লাহ নারী ও পুরুষের সম্পর্ককে চমৎকার ও অভিনব সব বিশেষণ দ্বারা ভূষিত করেছেন । যেমন এক আয়াতে আল্লাহ বলছেন—আর তাঁর নিদর্শনাবলির মাঝে একটি হলো তিনি তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন যুগলদের,যেনো তোমরা তাদের মাঝে স্বস্তি পেতে পারো, এবং তিনি তোমাদের মাঝে সৃষ্টি করে দিয়েছেন প্রেম ও দয়া। ( সুরা রুম- ২১)
পুরুষ সবসময়ই নারীর দিকে ধাবমান,তার সাথেই আবদ্ধ। যখন বিপদ আপদ কিংবা দুশ্চিন্তার বেড়াজালে আটকে হাঁসফাঁস করে তখন সে নারীর কাছেই আশ্রয় ও সান্ত্বনা পেতে চায় ।
কিন্তু অন্য সকল জিনিসের মতোই ,এ ক্ষেত্রেও যদি কেউ বাড়াবাড়ি করে,তাহলে এটা তাঁর জন্য নিঃসন্দেহে মন্দ বিষয়। যেমন নারীর ভালবাসায় তাকে পাওয়ার জন্য কেউ যদি হারাম পথ অবলম্বন করে, দ্বীন দুনিয়া ভুলে সর্বদা তার চিন্তা ফিকিরেই নিমগ্ন হয়ে থাকে, কিংবা বিয়ের সময় কোন নারীর রূপে পাগল হয়ে তাঁর দ্বীনদারিতার বিষয়টিকে গৌণ করে ফেলে, এবং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশ অনুযায়ী না চলে, তাহলে এই ভালোবাসা নিঃসন্দেহে নিন্দনীয়।
আরবের বিখ্যাত একটি প্রবাদ আছে—‘যে উপকার ভোগ করবে সে এর ক্ষয় ক্ষতির দায়ভারও বহন করবে’। নারীর অস্তিত্ত্ব পুরুষের নিকট যতটাই প্রিয় এর মাধ্যমে ফিতনায় পতিত হওয়ার আশংকাও ঠিক ততটাই প্রবল। সেজন্য কুরআনে মানুষের যত কমনীয় ও আগ্রহের বিষয়ের বর্ণনা এসেছে, এর মাঝে নারীদের কথা সবার আগে এসেছে। আল্লাহ পুরুষদের মনে সৃষ্টিগত ভাবেই এই আগ্রহ ও টান তৈরি করে দিয়েছেন।
ফলে দেখা যায় একজন পুরুষ দুনিয়ার সব কিছুকে তুচ্ছ করে তার পছন্দের নারীকে পাওয়ার জন্য ছুটে চলে। আমীর সানআনি এ হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন—‘‘কোন কোন স্ত্রী তাদের স্বামীদেরকে খারাপের দিকে নিয়ে যায়,এর মাঝে সবচে কম খারাপ হলো তাকে দুনিয়ার মোহে ভুলিয়ে দেয়া এবং সম্পদ অর্জনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত করা। এরকম ভুরি ভুরি ঘটনা রয়েছে,যা কারও কাছেই অজানা নয়;বরং প্রত্যেক মানুষই এর বাস্তবতা নিজেই উপলব্ধি করেছে । উক্ত হাদিসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর উম্মতের পুরুষদেরকে এই ফিতনার ব্যপারেই প্রস্তুত হতে বলেছেন। ( আমীর সানআনি,শরহে জামি’উস সাগীর- ৯/৩৭৫)
এমন কত বাবা আছেন, যারা তাদের সন্তানের কাছ কষ্ট পেয়েছেন,অথচ সন্তান ছিল তাদের কলিজার টুকরা! স্ত্রীকে নিরংকুশভাবে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে এমন কত সন্তান আছে যারা মা বাবার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে, অথচ আল্লাহর পরে তারাই হলেন একমাত্র উপায়, যাদের মাধ্যমে সে দুনিয়ার আলোর মুখ দেখেছে! তাদের সন্তুষ্টি ছাড়া তারজান্নাতের পথও বন্ধ !
দুনিয়া এমনই সুমিষ্ট ও সজিব। মানুষ নিরন্তর ছুটে চলে তার পছন্দ ও ভালোবাসার পেছনে । এর মাঝে নারী জাতি হলো সুন্দরতম ও ভালোবাসার জিনিস। পুরুষ তার ভালোবাসায় পাগল হয়ে আছে, ফলে পদে পদে পা পিছলানোর আশংকাও প্রবল। সেজন্য রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সতর্ক করে দিয়েছেন—এর পেছনে ছুটতে গিয়ে কেউ যেনো তার পরকালকে হারিয়ে না বসে। মোটেও নারীদের থেকে দূরে থাকতে কিংবা তাদেরকে ত্যাগ করতে বলা হয়নি কোথাও;বরং পরিমিতি বজায় রাখতে বলা হয়েছে, ফিতনায় পতিত হওয়া থেকে সতর্ক করা হয়েছে এবং হারাম ভাবে তাদের নিকটবর্তী হতে নিষেধ করা হয়েছে।
তাদের কথাই বরং বিস্ময়কর, যারা একদিকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নারী বিষয়ক বাস্তবোচিত সুন্দর এই কথাগুলো ব্যাপারে ঘোরতর আপত্তি তুলে,নারীদের জন্য অপমানজনক মনে করে,অপরদিকে তারাই প্লাটো এরিস্টটল কিংবা তাদের মতো দার্শনিকদেরকে “মানব জাতির প্রথম শিক্ষক” হিসেবে স্বীকার করে নেয়। এই উপাধি তারা কীভাবে দেয়, যারা বলে—“নারীর শরির মোটেও আকর্ষণীয় কিছু না, বরং এটা নোংরা ও দুর্গন্ধজনক বস্তু, আর বাচ্চা জন্ম দিতে পারা কোন গৌরব কিংবা সুখকর বিষয় নয়; এ বরং এটা পতিত ও নীচ হওয়ার নিদর্শন!”।
“ নারীর সৌন্দর্যই হলো সবচে বড় পাপের উৎস। সুতরাং যুবতি নারীদের থেকে দূরে থাকো, যেভাবে তোমরা আগুন থেকে দূরে থাকো” ।
“ যখন তোমরা কোন নারী কে দেখো তখন মনে করো না যে তোমরা কোন মানুষ কে দেখেছো, এমন কি কোন বন্য প্রাণীও না, বরং যাকে দেখেছো সে সাক্ষাত শয়তান! যখন সে কথা বলে তখন যা শুনো সেটা হলো সাপের হিস হিস”। ( দ্রষ্টব্য: আব্দুল ফাত্তাহ ইমাম রচিত—আফলাতুন ওয়াল মারআহ, আরাসতু ওয়াল মারআহ।)
কোথায় এসব কথা আর কোথায় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সেইসব নারীদের মর্যাদা সম্বলিত হাদিসগুলো! যেখানে তিনি এই উম্মতের কল্যাণকে নারীর আধিক্যের সাথে শর্ত যুক্ত করে দিয়েছেন! তিনি বলেন- এই উম্মতের কল্যাণ নিহিত আছে নারীর আধিক্যে। ( বুখারি-৫০৬৯)
কিংবা পৃথিবীর শ্রেষ্ট সম্পদ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন একজন সচ্চরিত্রা ও দ্বীনদার নারীকে। এই উম্মতের প্রতি তাঁর জীবনের সর্বশেষ যে উপদেশটাও ছিলো নারীদের কল্যাণ কামনায় – নারীদের সাথে উত্তম ব্যবহার করো, তাদের কল্যাণকামি হও। (
0 Comments